সোরিয়াসিস কী?
সোরিয়াসিস হলো একটি সাধারণ এবং দীর্ঘমেয়াদী ত্বকের রোগ, যেখানে ত্বকে রূপালী আঁশযুক্ত লালচে দাগ দেখা যায়। এই রোগে ত্বকের কোষগুলো অস্বাভাবিক দ্রুত গঠিত হয়, যার ফলে ত্বক মোটা, শুষ্ক ও খসখসে হয়ে পড়ে। আক্রান্ত স্থানে আঁশ খসে পড়ে এবং অনেক সময় অল্প রক্তক্ষরণ হতে পারে।
সারা বিশ্বে প্রায় ৫% মানুষ এই রোগে আক্রান্ত, এবং বাংলাদেশেও এর প্রাদুর্ভাব ক্রমেই বাড়ছে।
সোরিয়াসিস কি ছোঁয়াচে?
না, সোরিয়াসিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক কোনো রোগ নয়। এটি একেবারেই ব্যাক্তিগত একটি রোগ, এক জনের থেকে আরেক জনে ছড়ায় না।
কিভাবে সোরিয়াসিস দেখা দেয়?
স্বাভাবিক ত্বকে প্রতি ২৮ দিনে একটি নতুন কোষ স্তর তৈরি হয়, কিন্তু সোরিয়াসিসে মাত্র ৩-৪ দিনেই ত্বকের কোষ বেড়ে যায়। এই অতিরিক্ত কোষ ঠিকভাবে ঝরে না গিয়ে স্তূপ জমায় এবং তৈরি করে মাছের আঁশের মতো পুরু দাগ।
সোরিয়াসিসের বিভিন্ন প্রকারভেদ
- প্লাক সোরিয়াসিস: কনুই, হাঁটু, মাথা—যেখানে সাদা আঁশযুক্ত পুরু দাগ হয়।
- ইনভার্স সোরিয়াসিস: বগল, কুচকি ও পায়ুর ভাঁজে লালচে ক্ষত।
- গ্যাটেট সোরিয়াসিস: সারা শরীরে বৃষ্টির ফোঁটার মত ছোট ছোট ক্ষত।
- পাস্টুলার সোরিয়াসিস: চামড়ার নিচে পুঁজযুক্ত ক্ষত; গুরুতর ও জ্বরসঙ্গী।
- ইরাইথ্রোডার্মিক সোরিয়াসিস: পুরো শরীর লাল ও শুষ্ক হয়ে পড়ে।
- স্কাল্প সোরিয়াসিস: মাথার ত্বকে ঘন খুশকি ও লালভাব।

সোরিয়াসিস কি অস্থিসন্ধিতেও হয়?
হ্যাঁ। সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস নামক এক ধরনের সন্ধির প্রদাহ দেখা দিতে পারে, যা হাত, পা, হাঁটু ও গোড়ালিতে হয়। এটি সোরিয়াসিস আক্রান্ত এক-তৃতীয়াংশ রোগীর মধ্যে দেখা যায়।
সোরিয়াসিস কি নখেও হয়?
হ্যাঁ। নখ ভঙ্গুর, গর্তযুক্ত বা বাদামী হলুদ রঙের হতে পারে। অনেক সময় শুধু নখেও এই রোগ দেখা যায়, যা ছত্রাক সংক্রমণের সঙ্গে বিভ্রান্ত হতে পারে।
রোগ নির্ণয় কিভাবে হয়?
- রোগের ইতিহাস ও উপসর্গ বিশ্লেষণ
- ত্বক পরীক্ষা
- প্রয়োজনে বায়োপসি
- রক্ত পরীক্ষা (ঔষধ ব্যবহারের আগে ও পরবর্তীতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য)
সোরিয়াসিসের কারণ কী?
নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে:
- বংশগত প্রভাব
- ইমিউন সিস্টেমের গোলযোগ
- প্রদাহজনিত অবস্থা
কারা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন?
পুরুষ ও নারী উভয়েই আক্রান্ত হতে পারেন। সাধারণত ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
সোরিয়াসিস কি নিরাময়যোগ্য?
দুঃখজনকভাবে না। তবে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রেখে দীর্ঘমেয়াদী ভালো থাকা সম্ভব।
সোরিয়াসিসে যে জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে:
- ডায়াবেটিস
- হৃদরোগ
- বিষণ্নতা
- যৌন সমস্যা
- অতিরিক্ত ওজন
- সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস
বর্তমানে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি
- টপিকাল থেরাপি: করটিকোস্টেরয়েড, ভিটামিন-ডি, স্যালিসাইলিক এসিড ইত্যাদি।
- ফটোথেরাপি: UVB বা PUVA থেরাপি।
- সিস্টেমিক থেরাপি: মেথোট্রেক্সেট, সাইক্লোস্পোরিন, বায়োলজিক ওষুধ।
খাদ্য ও জীবনযাপনে সতর্কতা
বর্জনীয় খাদ্য:
- লাল মাংস, টমেটো, টক ফল
- পনির, চিনি, ফাস্ট ফুড, ধূমপান, মদ
উপকারী খাদ্য:
- সামুদ্রিক মাছ, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড
- শাকসবজি, গাজর, মিষ্টি আলু, ব্রকলি
মানসিক চাপের প্রভাব
সোরিয়াসিস ও মানসিক চাপ একে অপরকে বাড়িয়ে দিতে পারে। অনেক রোগীর মধ্যে হতাশা ও আত্মহত্যার প্রবণতা পর্যন্ত দেখা যায়। সঠিক মনোসামাজিক সহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সোরিয়াসিস প্রতিরোধযোগ্য কি?
এটি একটি অপ্রতিরোধযোগ্য রোগ, কারণ এর সঙ্গে বংশগতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
উপসংহার
সোরিয়াসিস একটি চ্যালেঞ্জিং ত্বক রোগ হলেও সঠিক চিকিৎসা, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন পালনের মাধ্যমে এটি দীর্ঘমেয়াদীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। নিজের বা পরিবারের কারো মধ্যে সোরিয়াসিসের লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
সংকলন ও সম্পাদনা:
ডা. মুহা. আলমগীর রেজা
চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল